প্লেসমেন্ট সহ মাস্টার্স ভালো নাকি প্লেসমেন্ট ছাড়া?

UK Higher Education এবং BSA-UK/IRL গ্রুপ থেকে আমরা একটা জনপ্রিয় মেন্টরশিপ প্রোগ্রাম চালাচ্ছি গত দুই বছর (এ প্রোগ্রাম সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এই লিঙ্কে দেখুন)। এখানে আমরা এ্যাপ্লিকেন্টদের ‘মেন্টরিং’ করি। অন্য আর দশটা এ্যাজেন্সি অথবা কনসালটেন্সির সাথে মেন্টরিং এর পার্থক্য হচ্ছে এখানে আমরা এ্যাপ্লিকেন্টদের সাথে কথা বলে তাদের ক্যারিয়ার, লক্ষ্য, সামর্থ্য ও ভবিষ্যত পরিকল্পনা আলোচনা করে কোর্স এবং বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে সাজেশন দিয়ে থাকি। শুধু তাই নয়, সেই সাজেশন অনুসরণ করে তাদের সিভি তৈরি করা, পার্সোনাল স্টেটমেন্ট/স্টেটমেন্ট অভ পারপাস লেখানো এবং রিভিউ করা, রেকমেন্ডেশন লেটার সংগ্রহ করা সহ এ ধরনের কাজগুলোতে প্রত্যক্ষ সাহায্য করে থাকি। পুরো প্রক্রিয়াটা ‘স্টুডেন্ট সেন্ট্রিক’। একজন এ্যাপ্লিকেন্টকে সামনে রেখে তার জন্যে যেটা ভালো, আমরা সেটা সাজেস্ট করার চেষ্টা করি। 

সম্প্রতি লক্ষ্য করছি এই প্রক্রিয়াতে একটা আলোচনা নিয়মিত আসছে। তা হচ্ছে ‘প্লেসমেন্ট’। অনেকেই মনে করছে প্লেসমেন্ট একটা খুবই ভালো অপশন। কিন্তু আসলে কি তাই? কিম্বা সেটা কাদের জন্যে ভালো অপশন এবং সেখানে কী ধরনের ঝুঁকির মুখোমুখি হবার সম্ভাবনা থাকছে নিয়মিত? এ লেখায় সে বিষয়গুলো তুলে আনার চেষ্টা করবো।       

শুরুতেই জানিয়ে নিচ্ছি, প্লেসমেন্টে যেতে চাওয়ার ইচ্ছেটা যদি কাজের অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্যে হয়, তাহলে সেটা ভিন্ন আলাপ এবং সে বিষয়ে পরে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। কিন্তু স্যাটেলমেন্টের পথে ১০ বছরের রুটে মাস্টার্সের সময় এক বছর বেশি থেকে এগিয়ে যাবার কথা চিন্তা করলে সেটা ভুল সিদ্ধান্ত। আবারো বলছি, যদি ইউকে শুধু ১০ বছর থেকে PR পাবার লক্ষ্যে আসার ইচ্ছে থাকে, তাহলে না আসাই ভালো। কারণ এই পথটা ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠেছে। প্রচণ্ড স্ট্রেসফুল এবং টাকা খরচ হবে। সেই চাপ অনেকেই নিতে পারে না। শেষ পর্যন্ত ক্যারিয়ারও হয় না, জীবনও না।

একটু ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছি এখানে। অনেকেই ২ বছরের কোর্সে আসতে চায় কারণ অতিরিক্ত একটা বছর পাওয়া যাচ্ছে যা লং রেসিডেন্সি রুট তথা ১০ বছর ইউকে থেকে ILR (PR) পাবার পথে কিছুটা সহায়তা করবে। এভাবে চিন্তা করাটা ভুল নয়। কিন্তু পরিস্থিতি যেভাবে কঠিন হয়েছে গত দশ-পনের বছরে, ইউকেতে ১০ বছর থেকে PR পাবার পথটা আর আগের মত নেই। স্রোতের মত টাকা বের হবে। তবুও যদি শুধু টাকার উপর দিয়ে যেত, তাও সেটা বিবেচনা করা যেত। ৭-৮ বছর থাকার পরই UKVI চেষ্টা করে কোন না কোন ভাবে বের করে দিতে। অনেকেই অবৈধ হয়ে যেতে বাধ্য হন। কেউ কেউ পর্তুগাল অথবা ফ্রান্সে চলে যায়। আর যারা ধুকে ধুকে ইউকে তে টিকে থাকে, তাদের সময় এবং বয়স প্রায় শেষ হয়ে আসে। ঐ সময় বের করে দিলে দেশে গিয়ে নতুন করে কিছু করার সুযোগ থাকে না। এ কারণে তারা দ্বারস্থ হয় কিছু কিছু দেশী সলিসিটরের যারা মিথ্যে আশ্বাস দেয়, ‘একটা কিছু করে দিব’ বলে। এদের একটা বড় অংশ হয় সুযোগসন্ধানী এবং অর্থলোভী। তারা জেনে শুনে নিশ্চিত ভিসা রিজেক্ট হবে এরকম স্কিমে আবেদন করে নিজের পকেট ভারী করে। ফলে নির্বোধ এবং অসহায় মানুষগুলো শুধু নিঃস্বই হয় না, ইমিগ্রেশন হিস্ট্রিও খারাপ হতে থাকে তাদের। ৭-৮ বছর পরে এই মানুষদের জীবনের একটা বড় সময় কাটে দরজার দিকে তাঁকিয়ে থেকে এই ভেবে যে কখন হোম অফিস থেকে আবার একটা চিঠি আসবে এবং কী ভয়ঙ্কর কথা লেখা থাকবে তাতে! মাঝ জীবনে এসে তারা দেখতে পায় ভবিষ্যত অন্ধকার, ফিরে যাবারও কোন জায়গায় নেই। তখন এ মানুষগুলোই সোস্যাল মিডিয়ার বিভিন্ন গ্রুপে, দেশে বেড়াতে গিয়ে আড্ডায় অথবা ফোনে কথা হলে বলে বেড়ায় ‘ইউকে আসবেন না। ইউকে খুব খারাপ জায়গা।’  

অতএব, ১০ বছর থেকে PR পাবার পরিকল্পনা করে প্লেসমেন্ট নিয়ে আসার চিন্তাটা শুরুতেই বাদ দেয়ার পরামর্শ দেব।

এবার চলে আসি আরেকটা কারণ, অর্থাৎ অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্যে যদি একজন এ্যাপ্লিকেন্ট প্লেসমেন্টে যেতে ইচ্ছুক হয়, সেক্ষেত্রে কী ঘটতে পারে। 

২ বছর মাস্টার্স জিনিসটা চালু করেছিল কিছু মধ্যম সারির  বিশ্ববিদ্যালয় যখন পোস্ট স্টাডি ওয়ার্ক তথা PSW বন্ধ করে দেয়া হয়। এতে প্রথম বছর থাকে যথারীতি মাস্টার্সটা, আর পরের বছর এক বছরের প্লেসমেন্ট। PSW বন্ধ হয়ে গেলে ইউকে তে ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট আসা চার ভাগের এক ভাগে পরিণত হয়। ফলে ইউনিভার্সিটিগুলোর একটা কিছু আবিষ্কার করার দরকার হয় যা দিয়ে তারা স্টুডেন্টদের আকর্ষণ করতে পারবে। আন্ডারগ্র্যাড পর্যায়ে প্লেসমেন্ট অনেক আগে থেকে চালু রয়েছে এবং এটা একটা খুবই ভালো অপশন স্টুডেন্টদের জন্যে। তারা আন্ডারগ্র্যাড করতে করতে এক বছরের প্লেসমেন্টে অনেক কিছু শেখারও সুযোগ পায় এবং অনেকেই পরে সেই প্লেসমেন্টের কোম্পানীতে জব নিয়েও যায় আন্ডারগ্র্যাড শেষে। আমি গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্সের টিউটর ছিলাম। একেকটা ছেলেমেয়েকে জেপি মর্গানের মত কোম্পানী পাশ করার আগেই জব দিয়ে নিয়ে যেতো। ছেলেমেয়েগুলো তাদের সেকেন্ড ইয়ারটা ওদের ওখানে প্লেসমেন্টে কাটিয়েছিল।

যাইহোক, এই জনপ্রিয় এবং কার্যকরী প্লেসমেন্টটাকে মাস্টার্সের মধ্যে নিয়ে আসে কিছু ইউনিভার্সিটি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এখানে একটা শর্ত রয়েছে। স্টুডেন্টকে প্লেসমেন্ট খুঁজে দেবার কাজটা ইউনিভার্সিটি করে দেবে না। যদি স্টুডেন্ট নিজে নিজে প্লেসমেন্ট খুঁজে নিতে না পারে, তাহলে তার দুই বছরের মাস্টার্স এক বছরে পরিণত হবে। দুই বছরের ভিসার এক বছরও কেটে নেয়া হবে। আর সবচেয়ে বেশি স্ট্রেসফুল বিষয় হচ্ছে, এই প্লেসমেন্ট ম্যানেজ করতে হবে প্রথম বছর শেষ হবার আগে আগেই— অর্থাৎ যখন ডিসার্টেশন নিয়ে একজন স্টুডেন্ট প্রচণ্ড ব্যাস্ত এবং সামনে হয়তো পরীক্ষাও অপেক্ষা করছে, তখন তাকে জবও খুঁজে বের করতে হবে। অনেকে এ কারণে স্যালারি না নিয়েই প্লেসমেন্টে যায়। তখন আবার আরেকটা সমস্যা হয়। অনেকের ওয়ার্ক কন্ডিশনে বলা থাকে শুধু প্লেসমেন্ট। ঐ সময় যদি আলাদা করে জব করার চেষ্টা করে কেউ, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেটা অবৈধ ভাবে ক্যাশ জব করতে হয়। আর যদি কোন রকম প্লেসমেন্ট ম্যানেজ করতে না পারে, তাহলে দুই বছরের মাস্টার্সের জার্নি এক বছরেই শেষ। অথচ হেলথ ইনস্যুরেন্স হিসেবে যে অতিরিক্ত এক বছরের IHS ফিস নেয়া হয়েছে, UKVI কিন্তু সেটা ফেরত দেবে না! প্লেসমেন্টের জন্যে অনেক ইউনিভার্সিটি আলাদা ফিস রাখে। কোন কোন ইউনিভার্সিটি সেটাও ফেরত দেয় না। অর্থাৎ প্লেসমেন্ট যেন একটা গ্যাম্বেল। খুঁজে না পেলে সব হারাতে হবে।

তাহলে কী করা যেতে পারে? একটা মিডল গ্রাউন্ড কিছু কিছু ইউনিভার্সিটি আনপেইড রিসার্চ প্রোজেক্টের মাধ্যমে তৈরি করেছে। অর্থাৎ যারা প্লেসমেন্ট খুঁজে পাচ্ছে না, তাদের একটা রিসার্চ প্রোজেক্ট করতে দিচ্ছে। এতে কোন টাকা পাবে না স্টুডেন্ট। কিন্তু এক বছরের ভিসাটা থাকবে। অনেকের সাথে কথা বলে দেখেছি এই প্রোজেক্ট খুব একটা ভালো কিছু নয় এবং স্টুডেন্টদের একটা বড় অংশ একে অপশন হিসেবেই দেখছে না। এর চেয়ে তারা ভিসা ছোট করে সরাসরি PSW তথা গ্রাজুয়েট ভিসায় যেতে আগ্রহী। আর এ কারণেই অনেক ইউনিভার্সিটি তাদের প্লেসমেন্ট সহ দুই বছরের মাস্টার্স বন্ধ করে দিচ্ছে। তিন বছর আগেও যে পরিমাণ প্লেসমেন্ট সহ মাস্টার্স দেখা যেত, এখন তার এক চতুর্থাংশও দেখা যায় না। প্রথম সারির ইউনিভার্সিটিগুলো আগেও তেমন প্লেসমেন্ট সহ মাস্টার্স অফার করতো না, এখন সেই সংখ্যা নাই বললেই চলে।

যাইহোক, এখন পরিস্থিতি বেশ বদলে গিয়েছে। আগের মত ঐ দুই বছরের মাস্টার্সের চল এবং কদর আর তেমন নেই। PSW ফিরে এসেছে গ্রাজুয়েট ভিসার নামে। মোটামোটি একই ধরনের ভিসা। ব্যাচেলর অথবা মাস্টার্সের পরে ২ বছরের এবং পিএইচডির পরে ৩ বছরের ভিসা পায় একজন স্টুডেন্ট। এই সময়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ স্পন্সর্ড ভিসায় যেতে হলে এই ২ বছর সোনালী সময়। আগে এই অপশনটা না থাকায় অনেকে মাস্টার্সে প্লেসমেন্ট নিয়ে আসতো। এখন আর সেটার দরকার নেই। আমার পরামর্শ থাকবে এক বছরের মাস্টার্সে আসার। তারপর ভালো করে মাস্টার্সটা শেষ করা। ডিসটিংশন অথবা মেরিট নিয়ে শেষ করার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করা উচিত সব স্টুডেন্টদের। ডিসার্টেশনে ভালো স্কোর করতে পারলে সেটা পরে সিভিতে বাড়তি গুরুত্ব যোগ করবে।

তারপর মাস্টার্স শেষে যখন হাতে চার মাস সময় থাকবে, ঐ সময়ট জব খোঁজায় ব্যবহার করা বুদ্ধিমানের কাজ। এর মাঝে PSW তথা গ্রাজুয়েট ভিসার জন্যে প্রস্তুত হয়ে আবেদন করে ফেলতে হবে। চার মাসে জব পেলে ভাল, না পেলেও সমস্যা নেই। PSW তে গেলে তখনও জব খোঁজা সম্ভব।

এরপর জব পেলে স্টুডেন্টের হাতে থাকবে দুই বছর। এই দুই বছরে কোম্পানীকে দেখাতে হবে তিনি কতটা যোগ্য। নিজেকে প্রমাণ করতে হবে এ্যাপ্লোয়ারের কাছে। তারা তখনই কাউকে স্পন্সরশিপ দিয়ে রেখে দিতে আগ্রহী হবে যখন দেখবে এই মানুষটাকে তারা চাইলেও সহজে রিপ্লেস করতে পারবে না। পাশাপাশি যে দুই বছর একটা কোম্পানীতে রয়েছে, সে কাজ শিখেছে এবং কোম্পানীকে জেনেছে। তাকে বাদ দিয়ে আবার নতুন করে কাউকে নেয়াটা কোম্পানীর জন্যে কখনই লাভজনক হবে না— এটা কোম্পানীও ভালো করে জানে। সে কারণে নিজেকে যোগ্য হিসেবে প্রমাণ করলে স্পন্সর্ড জবে যাওয়াটা কঠিন হওয়ার কথা নয়। আর একবার ‘সঠিক’ স্পন্সর্ড জবে ঢুকে গেলে অনেকটাই চিন্তা মুক্ত হয়ে যাওয়া যায়। ৫ বছর পর PR। 

একটা ছোট উদাহরণ দেই; তাও ব্রেক্সিটের আগের যখন স্পন্সর্ড জব পাওয়া ভীষণ কঠিন ছিল এবং PSW এর অপশনটা ছিল না। আমাদের BSA-UK/IRL গ্রুপের ম্যানেজমেন্ট টিমের ৬ জনের মধ্যে আমি, আতিক, শামস এবং তুষার স্পন্সর্ড জবে ছিলাম। পরে আমাদের PR হয়েছে। অন্য দুজনের একজন এ্যামেরিকায় চলে গিয়েছে পিএইচডি করতে, আরেকজনের হাজবেন্ড স্পন্সর্ড জবে রয়েছেন (উনি নিজেও চাইলে যেতে পারতেন, কিন্তু প্রয়োজন হয় নি)। ব্রেক্সিটের পরে স্পন্সর্ড জব পাওয়াটা এখন অনেক সহজ। কোম্পানীগুলোকে UKVI লাইসেন্সও দিচ্ছে সহজে এবং আগের চেয়ে কম খরচে।

যারা এ পোস্টটা পড়ছেন এবং ঠিক করতে পারছেন না প্লেসমেন্ট নিয়ে আসবেন নাকি প্লেসমেন্ট ছাড়া, তাদের বলবো— আমরা যদি কঠিন সময়ে স্পন্সর্ড জবে যেতে পারি তাহলে বর্তমান সময়ে আপনি কেন দুই বছরের PSW এর সুযোগ নিয়ে সেটা ম্যানেজ করতে পারবেন না? প্রশ্নটা নিজেকে করুন এবং করার পর যদি নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস অনুভব করেন, তাহলে প্লেসমেন্ট নয় বরং এক বছরের মাস্টার্সেই আসতে বলবো। অভিজ্ঞতা অর্জন আপনি পরে PSW তে গিয়েও করতে পারবেন। কিন্তু প্লেসমেন্ট খুঁজতে গিয়ে রেজাল্ট খারাপ হলে সেটার মূল্য অনেক চওড়া দামে পরিশোধ করতে হতে পারে ভবিষ্যতে।

আমি ডিসিশন চাপিয়ে দিতে চাচ্ছি না। ফ্যাক্টসগুলো তুলে ধরলাম যাতে আপনার জন্যে কোনটা ভালো হবে সেটা আপনি ঠিক করতে পারেন।

পোস্টটি মোট পড়া হয়েছে 2986 বার।

error: Content is protected !!